স্বদেশ ডেস্ক:
বাস, ট্রেন ও লঞ্চে প্রতিদিন মানুষ বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করছেন। গণপরিবহনে গাদাগাদি করে চলাফেরার কারণে করোনা ভাইরাসের ঝুঁকি অনেক বেশি। এ অবস্থায় কর্তৃপক্ষ বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। পাশাপাশি সতর্কতা হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং আইএমওর নোটিশ সর্বত্র টাঙানোর জন্য পাঠানো হয়েছে। এসব কার্যক্রমের পর যাত্রী ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সচেতন না হলে পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশে এখনো ভয়ানক আকার ধারণ করেনি করোনা ভাইরাস। তবে সংক্রমণের শঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় বাস, ট্রেন, লঞ্চ ছাড়াও রাইড শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। মোটরসাইকেলের রাইড শেয়ারিংয়ে ঝুঁকি বেশি এই যুক্তিতে যে, একই হেলমেট বহু ব্যক্তি ব্যবহার করে। বাস, ট্রেন ও লঞ্চের মধ্যে ঝুঁকি শুরু স্টেশন টার্মিনাল থেকেই। ভাঙা জানালার কাচ ও ভ্যাপসা গন্ধের পরিবেশ যাত্রীদের জন্য অস্বস্তির।
সড়কপথে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে জেলা শহর ও মহাসড়ক কোথাও পরিচ্ছন্নতার লক্ষণ নেই। ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় গাড়িতে স্প্রে করার নির্দেশনা ছিল। সেই সিদ্ধান্ত খুব বেশি আমলে নেননি পরিবহনকর্মীরা। ডেঙ্গুর চেয়ে কঠিন রোগ করোনা। এ অবস্থায় দেশের নিবন্ধিত ৪৩ লাখ ৯৪ হাজার ৩৬৫টি গাড়ির মধ্যে কতটা নিরাপদে রাস্তায় মানুষ পরিবহন করতে পারছে।
বাস মালিক ও তাদের প্রতিনিধিদের আশঙ্কা, কভিড ১৯-এর কারণে সামনের দিনে যাত্রী সংকট দেখা দিতে পারে। দেশের শীর্ষস্থানীয় পরিবহন কোম্পানি হানিফ পরিবহনের জেনারেল ম্যানেজার মোশারফ হোসেন বলেন, সরকার বা গণমাধ্যমের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের নিদের্শনা পাইনি। গত বছর যখন ব্যাপক হারে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটে, তখন আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল বাসে নিয়মিত অ্যারোসল স্প্রে করার। এবার যদি সে রকম কোনো নির্দেশনা আসে, তা হলে তা অবশ্যই পালন করব।
বিআরটিএর চেয়ারম্যান ড. কামরুল আহসান আমাদের সময়কে বলেন, পরিবহন নেতাদের সঙ্গে আমরা বৈঠক করব। সরকারি নির্দেশনার পাশাপাশি বিআরটিএর পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বাড়াতে সবাইকে উদ্যোগী করা এবং স্যানিটাইজার নিশ্চিত করতে বলা হচ্ছে।
প্রতিদিন অন্তত ২ লাখ ৭০ হাজার মানুষ ট্রেনে ভ্রমণ করেন। বেশিরভাগ ট্রেনই চলে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে। আন্তঃনগর, লোকালসহ ৩৬০টি ট্রেন দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচল করে। স্টেশন-প্ল্যাটফরমেও প্রচুর মানুষের সমাগম ঘটে। ট্রেনের যাত্রী ও স্টেশনে জমায়েত হওয়া মানুষের মধ্যে নভেল করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে রেলওয়ের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, ভাইরাসটি সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। প্রতিটি ট্রেন ও স্টেশনে সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। স্টেশন ও ট্রেনের ভেতরে হাত ধোয়ার জন্য পর্যাপ্ত হ্যান্ডওয়াশ-স্যানিটাইজার মজুদ রাখা হচ্ছে। ট্রেন ও স্টেশন এলাকায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম বাড়ানো হয়েছে। তবে রেল সচিব মোফাজ্জেল হোসেন জানান, পরিস্থিতি ভয়াবহ হলে ট্রেন বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকবে না। রেলের মহাপরিচালক শামসুজ্জামান বলেন, স্টেশন ও ট্রেন নিয়মিত পরিচ্ছন্ন রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
রেলওয়ের অপারেশন বিভাগের তথ্যমতে, করোনা প্রতিরোধের ৮ উপায় নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশিকা প্রতিটি কোচ ও প্ল্যাটফরমে লাগানো হয়েছে। রয়েছে পানি ও সাবানের ব্যবস্থা। এর সবই করা হচ্ছে ঢাকাসহ বড় বড় স্টেশনে। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের সব স্টেশনে তো এই ব্যবস্থা করতে সক্ষম নয় রেল। কোনো একটি স্টেশনে ওঠা যাত্রী থেকে অন্য যাত্রীরা সংক্রমিত হতে পারে। সুতরাং ঝুঁকি তো আছেই। আর স্যানিটাইজারসহ পরিচ্ছন্নতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে আপদকালীন উদ্যোগে কাজ চলছে। এটি নিয়মিত করতে হলে পৃথক বরাদ্দের দরকার।
বাস, ট্রেনের পাশাপাশি লঞ্চের মাধ্যমে দেশের মানুষ অন্যত্র যাতায়াত করেন। রাজধানীর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে ৬০-৭০টি লঞ্চ ঢাকা ছেড়ে যায়। আসেও প্রায় একই রকম। এর বাইরে বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে লঞ্চ চলাচল করে। ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চে যাত্রী থাকে গড়ে সহস্রাধিক, আর ঢাকার বাইরে তা কয়েকশ। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে দেখা দেওয়ায় বাংলাদেশেও নৌ খাতে সতর্ক করা হয়েছে। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী ও নৌসচিবের নেতৃত্বে একাধিক বৈঠক করা হয়। স্টেকহোল্ডার ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়াতে জোর দেওয়া হয়েছে। আর নৌ খাত চলে আন্তর্জাতিক মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের (আইএমও) অধীনে। ইতোমধ্যে আইএমওর পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর সৈয়দ আরিফুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, নৌ খাতের সতর্কতা বাড়াতে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ভাইরাসটি যেন না ছড়াতে পারে, সে জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং আইএমওর নোটিশ সর্বত্র পাঠানো হয়েছে। বৈঠক করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডার, বিআইডব্লিউটিএসহ সবার সঙ্গে। যেহেতু ঘাটের দায়িত্বে বিআইডব্লিউটিএ, তারাও এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিচ্ছে। নৌপরিবহন অধিদপ্তর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে।
বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া কভিড-১৯ প্রতিরোধে গণপরিবহন এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। যদিও বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের পক্ষে গণপরিবহন এড়িয়ে চলা কঠিন। এ অবস্থায় পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে গণপরিবহন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
করোনা প্রতিরোধে প্রস্তুতি হিসেবে চালক-পরিবহন শ্রমিকদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার কথা যেমন বলা হচ্ছে, তেমনি বলা হচ্ছে ট্রিপ শেষে গণপরিবহনে জীবাণুনাশক স্প্রে ব্যবহারের কথাও। যাত্রীদের গণপরিবহনে ওঠার সময় শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপের বিষয়টিও উঠে আসছে। পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে যাত্রীদের জন্য পর্যাপ্ত হ্যান্ডওয়াশ বা স্যানিটাইজার রাখারও। যতটা সম্ভব গণপরিবহন এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিলেও ব্যাপকহারে গণপরিবহন এড়িয়ে চলার মতো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি বলে মনে করছেন আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। তিনি বলেন, যারা দেশের বাইরে থেকে আসছেন, বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে তারা যাতে গণপরিবহনে না ওঠেন।